রহমানের হাত ধীরে ধীরে তোয়ালের প্রান্ত ছুঁতেই আন্টির সারা গা শিহরে উঠল। চোখ বন্ধ করে বলল—
“আজ আর কিছু বলবি না… যা হওয়ার, নিঃশব্দেই হোক…”
রাত দশটা পার হয়ে গেছে। রহমানের বাবা-মা শহরের বাইরে গেছে দুই দিনের কাজে। বাসাটা ফাঁকা। পাশের বাসার রশিদা আন্টি সন্ধ্যায় এসে কয়েকবার খোঁজ নিয়েছে—
“ঠিকমতো খেয়েছো তো রহমান?”
ও হেসে বলেছিল, “হুম আন্টি, ঠিক আছি।”
রশিদা আন্টির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু শরীরটা যেন বয়স মানতে নারাজ। কালো সালোয়ার আর হালকা খোলা চুলে তাকে যেদিন দেখলে, রহমানের বুকের ভেতর কিছু একটা ধাক্কা মারে। ছোটবেলায় সে তাকে খালি “আন্টি” বলেই চিনত, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্বোধনের ভেতরকার দূরত্ব নিশ্চুপে বদলে গেছে।
রাত সাড়ে দশটার দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। রহমান বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখল—রশিদা আন্টির বারান্দায় কাপড় শুকোতে দেওয়া। ভিজে যাবে বুঝে দরজায় গিয়ে নক করল না—বরং সোজা ওদের বাসার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দরজাটা আধা খোলা। ভেতরের আলো ঘোলাটে। রহমান ডাক দেবে কি দেবে না, ঠিক বুঝে ওঠার আগেই ভেতর থেকে শব্দ এলো—
শাওয়ারের পানি পড়ার শব্দ।
ওর বুক ধক করে উঠল।
হঠাৎ বাতাসে দরজাটা একটু খুলে গেল। রহমান অচেতনভাবে চোখ সরাতে চাইল কিন্তু পারল না।
ও ভেতরটা দেখতে পেল—
ড্রয়িংরুম পেরিয়ে সরাসরি করিডোর, তারপর বাথরুমের আধা খোলা দরজা… আর ওর ভেতর থেকে ভেসে আসা শব্দ।
কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর ওর চোখে ধরা পড়ল এক দৃশ্য—
রশিদা আন্টি শাওয়ার বন্ধ করে বেরোচ্ছে, কাঁধ থেকে ভেজা চুল ঝরে পড়ছে, শরীরে পাতলা তোয়ালে জড়ানো, বুক থেকে উরু পর্যন্ত আংশিক খোলা… আলো ভেজা ত্বকে লেগে চকচক করছে। হাঁটার সময় তোয়ালেটা একটু সরে যাচ্ছিল, কিন্তু সে খেয়াল করেনি।
রহমান দরজার ফাঁক ধরে নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, বুকের ঢিপঢিপানি কানে বাজছে। ও জানে—এভাবে তাকানো উচিত না, কিন্তু চোখ ফিরছে না।
ঠিক সেই সময় আন্টি আয়নার সামনে গিয়ে তোয়ালেটা একটু নামিয়ে চুল মুছতে লাগল। ঘাড় থেকে পিঠ বেয়ে পানি নামছে। রহমানের দুই হাত ঘামে ভিজে উঠল। ওর শরীরে অদ্ভুত কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল।
হঠাৎ আন্টির চোখ আয়নায় পড়ল… দরজার দিকে।
এক পলকের জন্য মনে হলো—সে কি রহমানকে দেখতে পেল?
রহমান পিছিয়ে যেতে যাবে, ঠিক তখনই ভেতর থেকে তার কণ্ঠ ভেসে এলো—
“রহমান… তুইই তো? বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
গলার স্বরে কোনো রাগ নেই—বরং নরম, অদ্ভুত উষ্ণতা। রহমানের মাথা কাজ করছে না। ও দাঁড়িয়ে রইল, পিছিয়ে আসার বদলে দরজাটা আরও একটু ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
রশিদা আন্টি তখনও তোয়ালে জড়ানো, দরজার সামনে দাঁড়ানো রহমানের দিকে তাকিয়ে হালকা ভিজা কণ্ঠে বলল—
“ভিতরে আয়… বৃষ্টি ভিজবি নাকি শুধু স্বপ্নই দেখবি?”
ওর গলা শুকনো, চোখে ধরা আছে ভয় আর তৃষ্ণার মিশ্র আগুন।
ধীরে ধীরে ও পা রাখল ভেতরে।
রশিদা আন্টির চোখে ভেজা জল আর শরীরে বৃষ্টির গন্ধ মিশে ছিল। রহমান দরজার ভেতর ঢুকতেই সে পেছন ফিরে ধীরপায়ে হেঁটে করিডোর পার হলো। রহমানের দৃষ্টি আটকে আছে তার পিঠ আর নরম হাঁটার ভঙ্গিতে। সারা ঘর নিঃশব্দ, শুধু টপটপ করে পানি পড়ার শব্দ।
রশিদা আন্টির তোয়ালে তখনো বুকের কাছে আটকানো, কিন্তু হাঁটার সময় নিচের দিকটা দুলে উঠছে… উরুর গোড়া পর্যন্ত দৃশ্যটা রহমানের চোখে বিদ্যুৎ নামাল। ওর গলা শুকিয়ে গেল, বুকের ভেতরে আগুনের ঝলক।
হঠাৎ আন্টি থেমে দাঁড়াল—বেডরুমের দরজার সামনে।
চোখ না ঘুরিয়েই বলল নিচু গলায়,
“দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ঢুকবি?”
রহমান কোনো উত্তর দিল না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দরজার ফ্রেমে হাত রাখল—ওর নিঃশ্বাস গরম, চোখে অপরাধ আর আকাঙ্ক্ষা একসাথে।
রশিদা আন্টি তখন একহাতে তোয়ালেটা ঠিক করতে করতে তার দিকে তাকাল। চোখে কোনো নিষেধ নেই, কোনো ভয়ও নেই… যেন সে আগেই জানত — এই রাত একদিন আসবে।
আচমকা বাতাসের ঝাপটায় আন্টির তোয়ালেটা একটু সরে গেল—ডান কাঁধ আর পিঠের অর্ধেক বেরিয়ে পড়ল। রহমানের চোখ পাথরের মতো স্থির।
রশিদা আন্টি ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলল—
“এভাবে দেখিস না… শরীরটা কাঁপে…”
রহমান আর নিজেকে থামাতে পারছিল না। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভিজে হাতে ঠেলে বন্ধ করল। ঘরটা অন্ধকার নয়, আলোটা কমলা মেঘের মতো নরম।
আন্টি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগল—কিন্তু এবার তার চোখ আয়নায় নয়… রহমানের চোখে।
রহমান এগিয়ে গিয়ে পিছন দিক থেকে খুব ধীরে বলল—
“অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল…”
রশিদা কোনো কথা বলল না, শুধু নিঃশ্বাস ফেলে পিঠটা সামান্য বাঁকাল। তোয়ালেটা এখন আর ঠিকমতো ধরে নেই… থরথর করছে শরীর।
রহমানের হাত ধীরে ধীরে তোয়ালের প্রান্ত ছুঁতেই আন্টির সারা গা শিহরে উঠল। চোখ বন্ধ করে বলল—
“আজ আর কিছু বলবি না… যা হওয়ার, নিঃশব্দেই হোক…”
ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। রহমানের বুকের ধপধপ শব্দ যেন দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে।
তোয়ালেটা ধীরে ধীরে আন্টির দেহ বেয়ে নেমে গেল মেঝেতে, আর রহমান বুঝল—স্বপ্নের দরজা আজ পুরোপুরি খুলে গেছে।
এরপর
বিছানার উপর বৃষ্টি আর শরীরের গন্ধ মিশে একাকার হলো।
রাত অনেক লম্বা…
আর রহমানের কারও কাছে কিছু বলা লাগবে না—
আর “আন্টি” শব্দটারও দরকার পড়ল না।

0 Comments